বানিয়াচংয়ের লোক-লোকান্তরে




“কমলা রাণীর দীঘি ছিল এইখানে,

ছোট ঢেউগুলি গলাগলি ধরি ছুটিত তটের পানে।

আধেক কলসী জলেতে ডুবায়ে পল্লী-বধূর দল,

কমলা রাণীর কাহিনী স্মরিতে আঁখি হত ছল ছল”

পল্লীকবি জসিম উদ্দীন ‘কমলা রাণীর দীঘি’ কবিতায় যে দীঘিটির বর্ণনা দিয়েছিলেন সেই দীঘিটি দেখার ইচ্ছে ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। কমলা রানির লোককাহিনি ছোটবেলা থেকে শুনে ও পড়ে এসেছি। কিন্তু এই দীঘিটি কেউ বলে মৌলভীবাজারের রাজনগরে, কেউ বলে হবিগঞ্জের বানিয়াচং, কেউ বলে নেত্রকোনায়। মৌলভীবাজারে জন্মস্থান হওয়ায় রাজনগরের দীঘিটি আমার দেখা হয়েছিল আগেই। এবার গন্তব্য পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ের দীঘি ও নান্দনিক সকল সৌন্দর্যে অবগাহন করার উদ্দেশে।

বৈশাখের সকাল। রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সূর্য একদম তেঁতে আছে। তীব্র গরমের এই সময়ে একটুখানি প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম হাওরে-অধ্যুষিত হবিগঞ্জ জেলার দুটো পাশাপাশি উপজেলায় ভ্রমণ করবো। উপজেলা দুটো হলো আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং। হবিগঞ্জের বাকি উপজেলাগুলো ভ্রমণ করা হলেও এই দুটোতে যাওয়া হয়নি আগে। সিলেট বিভাগের চার জেলার মিলনস্থল শেরপুর থেকে চারজন রওনা দিলাম বাইকে করে। তার আগে স্থানীয় জনতা রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নিলাম সকালের নাশতা। আজকে আমার ভ্রমণসঙ্গী মৌলভীবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক বড়ভাই নূরুল ইসলাম, হবিগঞ্জের সাংবাদিক স্নেহাশিস ফাহাদ আহমেদ ও ভিডিও জার্নালিস্ট শাহাবুদ্দিন।

সকাল ৯টা বাজার আগেই রওনা দিলাম দুটো বাইকে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে আউশকান্দি পৌঁছে ডানদিকে হবিগঞ্জের নবিগঞ্জ উপজেলার রাস্তাটি ধরলাম। গ্রামীণ পরিবেশে সুন্দর ও মসৃণ পিচঢালা পথ ধরে ৯ কিলোমিটার গেলেই নবিগঞ্জ উপজেলা সদর। সেটা পার হয়ে ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে বানিয়াচং উপজেলা। হাওরের বুকজুড়ে দৃষ্টিনন্দন রাস্তা ধরে বানিয়াচং পৌঁছে গেলাম দ্রুতই। সিদ্ধান্ত ছিল আগে আজমিরীগঞ্জ যাব, যেহেতু দূরের গন্তব্য। ফেরার পথে বানিয়াচং বেশি সময় কাটাব। আজমিরীগঞ্জ আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। কাছাকাছি উপজেলায় হওয়ায় একইসাথে দেখে আসার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তাছাড়া আজমিরীগঞ্জে উল্লেখযোগ্য কিছু নেইও দেখার মতো।

বানিয়াচং থেকে আজমিরীগঞ্জের দুটো রাস্তা আছে। একটার দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার, একটা ১২ কিলোমিটার। আমরা স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে শর্ট রাস্তাটাই ধরেছিলাম। তারপরের ইতিহাস ছিল করুণ! রাস্তাটার দূরত্ব কিছুটা কম হলেও গত বছরের বন্যায় ভয়াবহ খারাপ হয়ে গেছে। শরীরের হাড়গোড় একদম ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। পিছিয়ে আসার সুযোগ না থাকায় অগত্যা অনেক সময় লাগিয়ে গেলাম আজমিরীগঞ্জ। সকাল ১১টা বেজে গেলো পৌঁছাতে। সোজা চলে গেলাম আজমিরীগঞ্জ লঞ্চঘাটে।

আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় আজ থেকে ৮-১০ বছর আগেও যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল লঞ্চ ও শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা। লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যেত ভৈরব, মার্কুলি ও শেরপুরের উদ্দেশে। হাজার হাজার যাত্রী ও ঘন্টায় ঘন্টায় লঞ্চ আসা-যাওয়া করতো। কিন্তু এখন বানিয়াচং ও হবিগঞ্জের সাথে উপজেলার সড়ক যোগাযোগ তৈরি হওয়ায় লঞ্চে আর যাত্রী হয় না। দ্রুত যাওয়ার জন্য সড়কপথে সবাই যাতায়াত করে। লঞ্চঘাট তাই মৃতপ্রায়। আজমিরীগঞ্জ লঞ্চঘাটে এখন প্রতিদিন একটা লঞ্চই আসে, কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে। এই লঞ্চঘাট থেকে নদী পার হলেই একপাশে কিশোরগঞ্জের ইটনা, একপাশে সুনামগঞ্জের শাল্লা আর এই পাশে হবিগঞ্জ। তিনটি জেলার মোহনা বলা যায় এটাকে।

আমরা লঞ্চঘাটে কিছু সময় কাটালাম, চা খেলাম। দুয়েকটা কার্গো জাহাজ চোখে পড়ল। বিআইডব্লিউটির লঞ্চঘাটের ইজারাদারের সাথে কথা বললাম। জেনে নিলার এর সোনালি অতীত সম্পর্কেও। এরপর রওনা দিলাম বানিয়াচং উপজেলার দিকে। পথে দেখলাম বিলুপ্ত মুন সিনেমা হলের নামে রাস্তা। একসময় এখানে সিনেমা হল ছিল ভাবতেই অবাক লাগে! যা হোক, ফেরার পথে শহীদ জগৎজ্যোতি দাস বীর উত্তমের একটা নামফলক দেখে সেখানে ছবি তুলে নিলাম। বানিয়াচং পৌঁছে গেলাম দুপুর সাড়ে ১২টায়। এবার আর ভুল করলাম না। ডানপাশের মসৃণ রাস্তাটি ধরে এলাম। তিন কিলোমিটার বেশি হলেও রাস্তা ভালো হওয়ায় অনেক দ্রুতই এলাম।

মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদ, বানিয়াচং; ছবিঃ লেখক





ইতিহাসে বানিয়াচং

বানিয়াচং গ্রামের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। সিলেটের ইতিহাসে লাউড়, গৌড় ও জৈন্তা নামের তিনটি পৃথক রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। নৈসর্গিক রূপ আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের লালনভূমি হাওর অঞ্চলের প্রাচীন জনপদ সুলতানি আমলে করদ রাজ্য ও মুঘল আমলে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে স্থানান্তরিত লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল বানিয়াচং। এই গ্রামটি ১২০টি পাড়া বা মহল্লা নিয়ে গঠিত। মহল্লাগুলো ৪টি ইউনিয়নে ভাগ করা হয়েছে। বানিয়াচং গ্রামের নামেই করা হয়েছে বানিয়াচং উপজেলা। একসময় এই গ্রামটিকে এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বলা হতো। তখন আমেরিকার শিকাগো ছিল বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম। কিন্তু শিকাগো একটি বড় নগরীতে পরিণত হওয়ার পর আয়তন ও জনসংখ্যা বিবেচনায় বানিয়াচংই অনানুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম। গ্রামটির জনসংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি।

অসংখ্য হাওর-বাওর, নদী-নালা, দীঘির সাথে এই গ্রামের লোকজ ঐতিহ্য গ্রামটিকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে গ্রামটি একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে। শীতকালে যেমন এক রূপ, বর্ষায় তার বিপরীত। হাওর শুকিয়ে শীতে মাঠে পরিণত হয়, বর্ষায় জলে টুইটুম্বুর হয়ে ওঠে। কিংবদন্তি উপাখ্যান আলাল-দুলাল, রানি ভবানি, আমেনা সুন্দরী, আফজাল খান, আরজু বানুর স্মৃতিবিজড়িত এই জনপদে আধুনিক বাংলা গানের মহান শিল্পী সুবীর নন্দীরও জন্ম। আধুনিক অর্থনীতির অন্যতম পথিকৃত স্যার ফজলে হাসান আবেদ কিংবা সাইকেলে দেশের প্রথম বিশ্বভ্রমণকারী রামনাথের বিশ্বাসেরও বাড়ি বানিয়াচংয়ে। রাজা-বাদশাহদের বাড়ি ছাড়াও মোঘল আমলের মসজিদ, কয়েকশো বছরের প্রাচীন বিতঙ্গল আখড়াসহ নানা পুরাকীর্তি এই জনপদের ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষ দেয়।

বানিয়াচং পৌঁছে আমাদের ঘোরাঘুরির মূল পর্ব শুরু হলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা শুরুতে যাব সাগরদীঘিতে। সরকারি আলী কলেজের সামনে এসে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম দীঘিতে যাওয়ার রাস্তা সম্পর্কে। সে বলার আগেই একটা ছোট ছেলে বললো, আমি চিনি। তাকে বললাম, আমাদের সাথে যাবি? সে রাজি হয়ে গেলো। ৮/৯ বছরের ছেলে, অথচ কী সাহস! তাকে নিয়ে সোজা চলে গেলাম সাগরদীঘির ঘাটে। গিয়ে দেখলাম দীঘির পাড়ে নারীরা বৈশাখের বোরো ধান শুকোচ্ছেন। কৃষাণিদের এই দৃশ্য গ্রামবাংলার অন্যতম সৌন্দর্য। আমরা স্থানীয় এক তরুণকে পেয়ে তার কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনে নিলাম।

সাগরদীঘি বা কমলারানির দীঘি

ধারণা করা হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা পদ্মনাভ প্রজাদের জলের কষ্ট দূর করার জন্য একটা বিশালাকার দীঘি খনন করেন। লোকমুখে আছে এই দীঘি খননের পর পানি উঠছিল না। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা পদ্মনাভের স্ত্রী রানি কমলাবতী নিজেকে বিসর্জন দেন দীঘিতে। ফলে পানিতে ভরে ওঠে দীঘি। এই উপাখ্যানের সত্যতা যাচাই করা অনেকাংশেই অসম্ভব এখন। একই কাহিনি প্রচলিত আছে মৌলভীবাজারের রাজনগরের সাগরদীঘি ও নেত্রকোনার একটি দীঘিতেও। কাহিনি যাই থাকুক, এই দীঘি তৎকালে প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করেছিল এটা সত্য। এই দীঘি এখনও মানুষের নানা উপকারে আসে। মাছের চাষ হয় এখানে। আছে অসংখ্য প্রজাতির মাছ। দীঘি ইজারা দিয়ে সরকার এখান থেকে রাজস্ব পেয়ে থাকে। দীঘিটি মোট ৬৬ একরের হলেও জলসীমা রয়েছে ৪০ একরের। এই দীঘির লোককাহিনি নিয়ে পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের কবিতার পাশাপাশি অনেক নাটক, সিনেমা ও গানও রচিত হয়েছে। ময়মনসিংহ গীতিকার গানেও এসেছে এই দীঘিটির কথা।

দীঘির ঘাটে বসে দারুণ কিছু সময় কাটানোর পর আকাশ কালো হয়ে এলো। হয়তো বৃষ্টি নামবে। আমাদের তাই দ্রুত এখান থেকে অন্য গন্তব্যে যাওয়া উচিত। আমরা বাইক নিয়ে রওনা দিলাম বানিয়াচং রাজবাড়ির দিকে। শুনেছিলাম এখানে একটা রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। সেটা দেখতেই ছুটে চললাম আমাদের ছোট্ট গাইড ছেলেটিকে সাথে নিয়ে।

গৌড় রাজ্যের রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, বানিয়াচং ; ছবিঃ লেখক




বানিয়াচং রাজবাড়ি

গৌড় রাজ্যের রাজধানী যেহেতু বানিয়াচং ছিল, সেই রাজ্যের রাজবাড়িটাও শুরুতে বানিয়াচংয়ে ছিল। রাজা গোবিন্দ সিংহ গৌড় রাজ্যের অধিপতি হয়ে পদ্মনাভ দীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। গোবিন্দ সিংহ পরে ধর্মান্তরিত হয়ে হবিব খাঁ নামে অধিষ্ঠিত হন। রাজবাড়ির পাশে রয়েছে তার সমাধিও। সপ্তদশ শতাব্দীতে দেওয়ান আবেদ রাজা রাজবাড়ি এখান থেকে সরিয়ে বানিয়াচং কসবার উত্তরাংশে তথা দেওয়ানবাগে স্থাপন করেন বলে জানা যায়।

বর্তমানে রাজবাড়িটির একটি ছোট্ট অংশ টিকে আছে। একটা ঘরের ধংসাবশেষ শুধু দেখা যায়। মুঘল স্থাপত্যে নির্মিত রাজবাড়িটির নির্মাণ ও স্থাপত্যশৈলী দেখলে বোঝা যায় এর জৌলুস কতটা ছিল। আজ রাজা নেই, রাজত্ব নেই, কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে রাজবাড়িটি এখনও টিকে আছে। অনেক পর্যটক রোজ এটা দেখতে এলেও শুক্রবার ও শনিবার বিকাল ৪-৬টা পর্যন্ত গেট খুলে দেয়া হয় দর্শনার্থীদের জন্য। জানি না এমন অদ্ভুত নিয়ম কেন। আমরা সংবাদকর্মী পরিচয়ে বিশেষ অনুরোধে প্রবেশ করে রাজবাড়ির ভগ্নাংশটি দেখে নিলাম। বাড়ির সামনের ঘন, সবুজ ঘাসের চত্বরে বসে সময়ও কাটালাম। খুবই নান্দনিক একটি চত্বর। সুনসান ও নিরিবিলি পরিবেশ মুগ্ধ করল।

বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। ঘড়ির কাটা ছুঁয়েছে দুপুর দুইটায়। খিদেও চাগিয়ে উঠেছে সবার। স্থানীয় কলেজশিক্ষক ও সাংবাদিক আবু তাহের ভাইয়ের পরামর্শে আমরা চলে গেলাম পোস্ট অফিস রোডের পল্লীরাজ রেস্টুরেন্টে। সেখানেই আজকে আমাদের দুপুরের খাবার খেতে হবে। রেস্টুরেন্টে ঢোকার পরপরই এলো ঝুমবৃষ্টি। রেস্টুরেন্টের একটা কেবিনে আমাদের পিচ্চি গাইডসহ খেতে বসলাম। সাদা ভাতের সাথে মাছের ভর্তা, ভাজি, দেশী ছোট টেংরা মাছ ও মুরগির মাংস দিয়ে দারুণ একটা ভোজ হলো। খাবার শেষ করে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় বসে থাকলাম। বৃষ্টি সামান্য কমতেই আমাদের সাথে যোগ দিলেন আবু তাহের ভাইও। উনিও লাঞ্চ করে নিলেন। এরপর চা-চক্র শুরু হলো। চা আর আড্ডা চলতে চলতে বৃষ্টি থামল বিকেল সাড়ে তিনটায়। আমরা আর দেরি না করে বের হয়ে গেলাম। এবার আমাদের গন্তব্য জলাবন লক্ষ্মী বাওর। যেতে যেতে দেখে নিলাম ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের বাড়ি। লক্ষ্মী বাওর যাত্রায় আমাদের সাথে যোগ দিলেন আরেকজন স্থানীয় সাংবাদিক ও বানিয়াচং উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এসএম খোকন ভাই।

লক্ষ্মী বাওর জলাবন হতে পারে বানিয়াচংয়ের সেরা পর্যটন গন্তব্য; ছবিঃ লেখক




লক্ষ্মী বাওর জলাবন

লক্ষ্মী বাওরে যেতে হলে শাখা কুশিয়ারা নদী পার হয়ে যেতে হয়। শুকনো মৌসুমে নদীতে বাঁধ থাকে। সেটা দিয়ে বাইক, ছোট গাড়িও চলে। কিন্তু এখন বৃষ্টিতে বাঁধ ডুবে গেছে। নৌকায় বাইক ও মানুষ পারাপার হয়। আমরা তিনটি বাইক ও ছয়জন মানুষ নৌকায় করে পার হলাম। বৃষ্টি হওয়ায় নদীর পাড় পিচ্ছিল হয়ে গেছে, তাই ওঠানামার সময় একটু অসাবধান হলেই বাইক নিয়ে নদীতে পড়ার সম্ভাবনা আছে। যা হোক, বাইক নিয়ে হাওরের বুক চিরে ছুটে চললাম অল ওয়েদার সড়ক ধরে। হাওরের বুকে এই সাব-মার্সিবল সড়কগুলো হাওরবাসীর যোগাযোগব্যবস্থায় এনেছে ভিন্নমাত্রা।

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলাবন খুবই বিখ্যাত। কিন্তু রাতারগুলের চেয়েও অনেক বড় এই লক্ষ্মী বাওর জলাবন। বলা যায় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলাবন। কিন্তু এই নান্দনিক বনটি এখনও অনেকের কাছে অপরিচিত। বনের মাঝখান দিয়ে অল ওয়েদার সড়ক আর চারপাশে সবুজ গাছ-গাছালি। বর্ষায় জলে ডুবে থাকে বনটি, কিন্তু শুকনো মৌসুমে বনের গহীনে হেঁটেই যাওয়া যায়। হিজল-করচের সাথে জানা-অজানা অসংখ্য উভচর গাছ বনটিকে করে তুলেছে অনিন্দ্যসুন্দর। পুরো বনে এত পরিমাণ পাখি যে কানে শুধু কিচিরমিচির আওয়াজই আসে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি, বিষধর সাপেরও বিচরণক্ষেত্রে এই লক্ষ্মী বাওর। ঠিকভাবে সরকার থেকে পরিচর্যা ও সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিলে বনটি হবে বানিয়াচংয়ের সেরা পর্যটন গন্তব্য এটা বলে দেয়াই যায়।

লক্ষ্মী বাওরে পুরো বিকেল কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের ফিরতে হবে বানিয়াচং সদরে। শেষবিকেলের আলোয় পাখ-পাখালির গানে মুগ্ধ হয়ে হাওরের বুক ধরে ছুটে চললাম। ফেরার পথে একটা গেস্ট হাউজ চোখে পড়ল। লক্ষ্মী বাওরের পর্যটকদের জন্য জেলা প্রশাসন করে দিয়েছিল। কিন্তু এটা এখন ব্যবহার হচ্ছে না। জানালার কাঁচগুলো ভাঙা ও দরজাগুলো খোলা। সম্ভবত ভেতরের সবকিছু লুট হয়ে গেছে। সময় না থাকায় আর ভেতরে গেলাম না। নৌকাঘাটের দিকে রওনা দিলাম।

বানিয়াচং এসে আবার চা-চক্র বসল। কিছুক্ষণ সেখানেই কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এলো হাওরের জনপদে। আমাদের আজ ফিরতে হবে। তাহের ভাই ও খোকন ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বানিয়াচং ভ্রমণের আরও অনেক কিছু দেখা বাকি রয়ে গেছে যদিও। হয়তো আবার আসব এখানে, তাই প্রকৃতি কিছু অদেখা জমা রেখে দিয়েছে। রাতের বুক চিরে হাওরের মাঝখান দিয়ে সুনসান রাস্তা ধরে ফিরছি চারজন পর্যটক। পথে রেখে যাচ্ছি অসংখ্য স্মৃতি আর কিছু ঘোরলাগা নান্দনিক মুহূর্ত।

এভাবেই নৌকায় শাখা কুশিয়ারা পারাপার হয় মানুষ ও বাইকগুলো; ছবিঃ লেখক




যেভাবে যাবেন

বানিয়াচং যেতে হলে ঢাকা থেকে বাসে ও ট্রেনে যাওয়া যাবে। বাসে হবিগঞ্জ গিয়ে সেখান থেকে সিএনজি কিংবা লোকাল বাসে বানিয়াচং যাওয়া যায়। আর ট্রেনে গেলে শায়েস্তাগঞ্জ জংশনে নেমে সেখান থেকে নবীগঞ্জ হয়ে সিএনজি নিয়ে বানিয়াচং যাওয়া যাবে।

যেখানে থাকবেন

বানিয়াচং ছোট ছোট হোটেল আছে। তবে খুব ভালো মান আশা করা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় হবিগঞ্জ শহরে রাতে থাকলে। সেখান থেকে সহজেই বানিয়াচং যাওয়া যায়।

যেখানে খাবেন

বানিয়াচং পোস্ট অফিস সড়কে পল্লীরাজ রেস্টুরেন্টের খাবারের মান ভালো ছিল, পরিবেশও মোটামুটি সুন্দর। এছাড়াও অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে সর্বত্র। হাওরের দেশী তাজা মাছগুলো ট্রাই করতে ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ